মঈনুল আলম ছোটন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ‘পিআর’ নিয়ে বিতর্ক চরম পর্যায়ে। তত্ত্বগতভাবে এটি ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করে রাজনীতিকে অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারে; ক্ষুদ্র দল, সংখ্যালঘু ও নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে হঠাৎ করে এ পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া মানে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা, জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন বীজ বপন করা – এগুলোও যে বাস্তব আশঙ্কা, তা অবহেলা করা যায় না।
প্রথমত, সংবিধানিক ও আইনি বাস্তবতা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে পিআরের সরাসরি উল্লেখ নেই; ফলে এমন মৌলিক পরিবর্তন সংবিধান সংশোধন ও আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া করাটা সম্ভাব্য নয়। নির্বাচন কমিশনও স্বতন্ত্রভাবে প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই আইনি অনিশ্চয়তা নির্বাচনী পরিবেশকে সংকটাপন্ন করবে, যা দেশকে সময়মতো নির্বাচন থেকে বিচ্যুত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জনগণের প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক বহুল জ্ঞানগম্যতার অভাব রয়েছে। আমাদের ভোটপর্যায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিবর্হিভূত সম্পর্কভিত্তিক; ভোটার প্রার্থীর নাম চিনে, তাকে প্রতিশ্রুতির জন্য দাঁড় করিয়ে ভোট দেন। পিআর চালু হলে সেই সরাসরি সম্পর্ক দুর্বল হবে এবং ভোটার-প্রতিনিধি জবাবদিহি কক্ষচ্যুত হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অকপট সংশয় তৈরি হবে। “আমি কাকে ভোট দিচ্ছি?” জাতীয় রাজনীতির সেই মৌলিক প্রশ্নটি জাঁকিয়ে বসবে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকলে পিআর তালিকা-মনোনয়নে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেবে। যে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নয়, সেখানে পিআর অত্যন্ত অনুকূল হবে না, বরং দলীয় সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী করে দেবে। ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বদলে স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেবে।
চতুর্থত, পিআর ইস্যু ব্যবহার করে নির্বাচন বিলম্ব ও রাজনৈতিক অবস্থান সাজানোর কৌশল সহজেই গঠিত হতে পারে। বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক ঐক্যতাই দেশের জন্য বড় শক্তি, সেটাই নষ্ট হওয়ার পরিণতিতে আমরা অস্থিতিশীলতার আরো গভীরে পা ফেলতে পারি। তাই এই বিতর্ককে কোনো অনিচ্ছিত অস্থিরতার জায়গা করে তোলা দেশব্যপী বিপদ ডেকে আনবে।
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার রক্ষা আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। নির্বাচন নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা, বিলম্ব বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা কাম্য নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী যে গণতান্ত্রিক ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেটাই সংরক্ষণ করতে হবে। বক্তব্য-বিবাদ, মতভেদ সবই থাকা উচিত, কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের ঐক্য ভাঙতে দেয়া যাবে না। ঐক্যবদ্ধ থেকে আমরা একটি স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক ও সময়মতো নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।