শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সংস্কার কমিশন গঠন অতীব জরুরি
-লায়ন মোঃ আবু ছালেহ্
আমার সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে যেমন আমি ভাবছি তেমনি আমার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনাও আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। একসময় শিক্ষাকে মূল্যায়ন করেনি কিন্তু এখন শিক্ষা ছাড়া কোন গতি নেই কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ দশা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবহিত। গত পাঁচ দশকেও আমরা একটি যুগোপযোগী, গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবারন করতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। ফলে শিক্ষার সর্বস্তরে বিরাজ করছে নৈরাজ্য। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা আজ নানা সমস্যায় আক্রান্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে এবং এগুলোকে দুর্নীতি গ্রাস করেছে। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে শিক্ষাঙ্গনকে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দলীয় বিবেচনায় নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এতে শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নগামী হয়েছে এবং তা শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। একুশ শতকে উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ সমাজ তৈরি প্রায় অসম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থা মূলত একটি ফ্যাক্টরি বা কারখানার মতো। ফ্যাক্টরির মেশিনপত্র বা আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি যত আধুনিক হবে তার ফিনিশ্ড প্রডাক্টও তত উন্নত হবে। তেমনই শিক্ষাব্যবস্থাও অত্যাধুনিক, মানসম্মত ও যুগোপযোগী হলে যথার্থ শিক্ষিত তরুণ সমাজ আমরা আশা করতে পারব। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে যে ধরনের শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে, তুলানামূলকভাবে আমরা সেদিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের লাইব্রেরিতে বইয়ের সংগ্রহ আশঙ্কাজনকভাবে কম। অবশ্য লাইব্রেরিতে বই পড়া বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে এবং প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। লাইব্রেরিতে সাম্প্রতিক বই, ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা অত্যন্ত অপ্রতুল। আমাদের সিলেবাসও যে কারণে পুরোনো ধাঁচের। একে সম্পূর্ণরূপে পুনর্বিন্যাস এবং পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে হবে। ল্যাবরেটরিকে আধুনিকায়ন এবং কম্পিউটারাইজড লাইব্রেরির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নতুন ও অতি-সাম্প্রতিক বই, পত্রপত্রিকা পাওয়া যায়। জ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করার সুযোগ করে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। এ জন্য বিশেষভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের পাঠ্যসূচিকে যুগোপযোগী করে সাজাতে হবে।
শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা শেষ করলেও যথার্থ অর্থে শিক্ষিত হতে পারছে না। উন্নত দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান ও পদ্ধতি তাদের সৎ ও সভ্য করে তুলছে। সেসব দেশে নকলের প্রবণতা নেই বললেই চলে। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার দরকার। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক ও আদর্শবান করে গড়ে তুলতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে জাতীয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করার জন্য।
রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো; যথা-অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, অনেক কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষা কমিশন রূপে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে শিক্ষার সংস্কার একটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কর্তব্য। কেননা শিক্ষাই হচ্ছে একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায় না। বর্তমান সরকারের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে জাতিকে একটি আদর্শগত শিক্ষার পরিবেশে আবার ফিরিয়ে আনা। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি জাতীয় প্রয়োজন; যার কোনো বিকল্প হতে পারে না। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে শিক্ষার সব স্তরে। এমনকি বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রেও দলবাজির নিকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে। এর অনিবার্য ফল দাঁড়িয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে এক অসহনীয় সর্বনাশা অবনতি। এ অবনতি এমন স্তরে নেমে গেছে যে, বাংলাদেশে আদৌ কোনো সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা আছে কি না, তা এক গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। আধুনিক বিশ্বে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। উচ্চশিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্ঞানের জগতে বহু নতুন জ্ঞানের সংযোজন হয়েছে; সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্ব জ্ঞানভান্ডার। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ, উঁচু মান এবং অধুনা সৃষ্ট জ্ঞানবিজ্ঞান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। এ যুগ বিশ্বায়নের যুগ। সমগ্র বিশ্বকে একটি বৃহৎ পল্লীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অতএব, এ বৃহৎ পল্লীর এক অঞ্চলের উন্নয়নের প্রভাব অন্য অঞ্চলে পড়তে বাধ্য। তাছাড়া জ্ঞানের জগতে কোনো সীমারেখা নেই। আমাদের দেশে সীমিত আকারে উচ্চশিক্ষার প্রচলন বহুকাল আগেই শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়। এর পর থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে পৃথিবীর এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।
তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ ছিল, যেখানে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হতো। এ সীমিত সুযোগ গ্রহণ করেছিল এ অঞ্চলের এক উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান ছিল পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর। এর কারণ ছিল ঐতিহাসিকভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের অনীহা এবং উচ্চশিক্ষার অত্যন্ত সীমিত সুযোগ। তাই উচ্চশিক্ষার প্রসারকল্পে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। এ পটভূমিতে ১৯২১ সালে ঢাকা শহরের রমনার মনোরম পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সে বছরের জুলাই থেকে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে এ দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় শিক্ষার মান ক্রমেই অবনতিশীল হয়। নানা কারণে পাঁচ দশক ধরে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিম্নমুখী। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক-সব স্তরে শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছে, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই উচ্চশিক্ষার স্তরেও।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে এবং একটি আদর্শগত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন অতীব জরুরি।