বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব । বৈশাখ মাসে এই পূর্ণিমা দিবসে মহামানব বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপুর্ন ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে দিনটি বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে খ্যাত ।
দিনটিকে ঘিরে সারা বিশ্বের ন্যায় আজ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার ১৩ টি বৌদ্ধ পল্লীর বিহারগুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ। জানা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এই দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন । ৫৮৮ খ্রিস্ট পূর্বাকের এ দিনে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন এবং ৫৪৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের এ দিনে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন । সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়েই জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয় ।
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায়, পূর্ব জন্মে বৌধিসত্ব সকল পারমী পূরণ করে সন্তোষ কুমার নামে যখন স্বর্গে অবস্থান করেছিলেন , তখন দেবগণ তাঁকে জগতের মুক্তি এবং দেবতা ও মানবের নির্বাণ পথের সন্ধান দানের জন্য মনুষ্যকূলে জন্ম নিতে অনুরোধ করেন । দেবতাদের অনুরোধে বোধিসত্ব সবদিক বিবেচনাপূর্বক এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় স্বপ্ন যোগে মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় লুম্বিনী কাননের শাল বৃক্ষ ছায়ায় উন্মুক্ত আকাশ তলে জন্মলাভ করেন । তাঁর নিকট জাতি ধর্ম- বর্ণ ও গোত্রের কোনো ভেদাভেদ ছিল না । তিনি সকল জীবকে প্রাণী রুপে জানতেন এবং সব প্রাণসত্তার মধ্যেই যে কন্ঠবোধ আছে তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন । তাই তিনি বলেছিলেন ‘ সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখী সত্তা ‘ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক । এই মর্মচেতনা জাগ্রত করা এবং এই পরম সত্য বলার জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন । সত্যের সন্ধানে পরিভ্রমণ করতে করতে এক সময় তিনি গয়ার উরুবেলার ( বুদ্ধগয়া) গিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে সাধনা মগ্ন হন । দীর্ঘ ছয় বছর অবিরাম সাধনায় তিনি লাভ করেন সম্যক সম্বুদ্ধ বা বুদ্ধত্ব । সেদিন ও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি ।
বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধদেব জীবের মুক্তি কামনায় ‘ ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র ‘ নামে জীবনের সর্ববিধ ক্লেশ থেকে মুক্তির উপায় আবিষ্কার করেন । তিনি চতুরার্য সত্য নামে খ্যাত এক তত্তে জীবনে দুঃখের উৎপত্তি ও দুঃখ ভোগের কারণ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেন । মুক্তির এই পথ নির্দেশনাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটটি আর্য পথ । দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে তাঁর এই ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন । রাজা- প্রজা, ধনী – নির্ধন, কুলীন – অন্ত্যজ সর্বশ্রেণীর মানুষের নিকট মুক্তির কথা তুলে ধরে তিনি জগতের এক নতুন ধর্মাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন । আশি বছর বয়সে হিরণ্যবর্তী নদীর তীরে কুশিনারার মল্লাদের শালবান জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগপূর্বক তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন । এই মহাপরিনির্বাণ লাভের ক্ষণ ও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি । বুদ্ধ পূর্ণিমা দিনে বৌদ্ধরা বুদ্ধপূজাসহ শীল সমাধি প্রজ্ঞা অনুশীলনে সমবেত প্রার্থনা এবং নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিধ সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । বৌদ্ধ বিহার গুলোতে বুদ্ধের মহাজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হয় । বৌদ্ধ ধর্মীয় পর্ব হিসেবে এ দিনে সাধারণ সরকারি ছুটি থাকে । বিভিন্ন বিহার ও সংগঠন কর্তৃক স্বরণীকা, ম্যাগাজিন ও স্বারকগ্রন্থ ও প্রকাশ করা হয় । বিভিন্ন গ্রামে মেলা বসে । তন্মধ্যে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া বোয়ালখালী গ্রামের বোধিদ্রুমের মেলা বিখ্যাত।
লেখিকা : অনামিকা বড়ুয়া