চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে আজ ১৪ই মে ২০২৫ তারিখে, এ উপলক্ষে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বর্ণাঢ্য সাজে সেজেছে। ক্যাম্পাসে আসছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার, হাটহাজারীর কৃতি সন্তান প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয় পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে সাজ সাজ রব, চলুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু আলোচনা করি। সালটা ১৯৫৮ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দিলেন জাকির হোসেনকে,জাকির হোসেন গভর্নর থাকাকালীন
এ,কে,এম ফজলুল কাদের চৌধুরীকে তার প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন,এই সময় তৈরী হচ্ছিল দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেন, সমস্যা দেখা দিলো এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে চট্টগ্রাম বিভাগে,আর তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তৃতি ছিল আজকের কুমিল্লা নোয়াখালী হয়ে সিলেট পযর্ন্ত,সমস্যা আরো গভীরতর হয় ১৯৬০ এর শেষের দিকে জাকির হোসেনকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী লেঃ জেনারেল মুহাম্মদ আজম খান এখানকার গভর্ণর পদে নিয়োগ পেলে, এতে ফজলুল কাদেরের হাত থেকে সুযোগ ফসকে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে ‘বিভাগ’ শব্দটি সংযুক্ত থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ করে সিলেট ও কুমিল্লা জেলাও আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীতে এক পর্যায়ে সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছাত্রদের দ্বারা ঘেরাও হন,অবস্থা বেগতিক দেখে গভর্নর আজম খান গাড়ি থেকে বের হয়ে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীমায় ঘোষণা দেন- ‘‘এয়ে থার্ড ইউনিভার্সিটি হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ক্যা মুলক সিলেটমে হুগা’’। অর্থাৎ হযরত শাহজালাল (রাঃ) র দেশ সিলেটেই তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে। ব্যস শেষ সুযোগও নষ্ট হয়ে যায়, ফজলুল কাদের চৌধুরী অন্য ধাতুর মানুষ ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী তার ১৯৬২ সালের বিশাল নির্বাচনী এলাকায় (সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা) দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন- আমি নির্বাচিত হই আর না হই, তবে বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা আমি নেব এবং ইনশাআল্লাহ্ আমরা এই উদ্যোগে সাফল্য অর্জন করবই।
সামরিক সরকারের নির্ধারিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কথা বলার সাহস কেবল তারই ছিল,সৌভাগ্যক্রমে তিনি নির্বাচনে জিতেন,যদিও তখনও সব কাগজে কলমে চুডান্ত হয়নি তবে সবাই সে সময়ে ঠিকই বুঝতে পারছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র কৱে পুরো শহর বদলে যাবে। নতুন ইতিহাস তৈরি হবে,কুমিল্লা জিলা হতে মফিজ উদ্দিন আহমদ প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী (১৯৬২-৬৫) হওয়ায় পর পরিস্থিতি আরো প্রতিকূলে চলে যায়,তিনি কুমিল্লায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জোর লবিং ও আন্দোলন শুরু করেন। সিলেটবাসীও তাদের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে অপরদিকে প্রাদেশিক গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খানও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে সিলেট কুমিল্লার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এমনি এক নাজুক অবস্থায় ফজলুল কাদের জুয়া খেলার মত এক ঝুকি নিলেন,তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেন এবং ঝুকিতে তিনি জিতে জাতীয় পরিষদের স্পীকার নির্বাচিত হন। জনশ্রুতি আছে স্পীকার হবার পর ফজলুল কাদের প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে একদিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। তার প্রথম ও একমাত্র যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থাপনের অর্থ অনুমোদনে স্বাক্ষর। তবু বিপদ কাটেনি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সমৃদ্ধশালী সিলেটবাসী তাদের বৈদেশিক অর্থের বিনিময়ে সরকারের অর্থ সাশ্রয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ জোগানের প্রস্তাব দেয়, গভর্নর মোনায়েম খান এতে মৌন সম্মতি দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে সিলেটেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে, ফজলুল কাদের তখন কোপেনহেগেন সফরে, পরিস্থিতি আওতার বাহিরে, সে মূহুর্তে ফজলুল কাদের তার সুহৃদ আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে টেলিফোনে যেকোন কিছু করার অনুমতি দিয়ে বলেন আমি কোপেনহেগেন থাকাকালীন শুনতে চাই যে, আপনি চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা ঘোষণা দিয়েছেন। আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে গভর্নর মোনায়েম খান স্পষ্ট বলে দিলেন ২৫ লক্ষ টাকা প্রাথমিক ফান্ড আজকের মাঝেই জমা দিতে হবে নচেৎ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে চলে যাবে,সেকালে ২৫ লক্ষ টাকা মূল্যমান আজ কত টাকা হয় তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, হাতে মাত্র কটা ঘন্টা। জনাব সিদ্দিকী এই কটা ঘন্টায় ফান্ড সংগ্রহের জন্য বের হলেন এবং জমা করলেন,চট্টগ্রামের সুলতান আহমদ, এম,এ জলিল, হাজী রাজ্জাক, হাজী জানু, আলহাজ্ব ইসলাম খান, এম,এম ইস্পাহানী মির্জা, আবু আহমদ প্রমুখ ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে এই ফান্ড সংগ্রহ করা হয়। সমাবর্তনে এই মানুষগুলোর কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ না করলে অন্যায় হবে।
আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর নাম কেউ ঘুন্নাক্ষরেও উচ্চারণ করেন না। যার প্রধান কারণ হল তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা, ইতিহাস তাকে ছাইচাপা দিয়েছে।
আমরা চাই আজ ১৪ ই মে ২০২৫ ইং ইতিহাসের দায় শোধ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া হবে। এ,কে,এম ফজলুল কাদের চৌধুরী মানেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মানেই এ,কে,এম ফজলুল কাদের চৌধুরী।
লেখকঃ মানবাধিকার ও সমাজকর্মী
লায়ন মোঃ আবু ছালেহ্ সম্পাদিত ও হাজী জসিম উদ্দিন প্রকাশিত