
লেখাটি একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে পতিত হওয়ার বাস্তব গল্প। সেই মেয়েটির সঙ্গে একজন নারীবাদী লেখকের বিবাহ পূর্ব-অভিজ্ঞতা ও বিবাহ পরবর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে। লেখাটি দেখায় যে, একটি কু-প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ কী পরিমাণ অপ্রত্যাশিত হতে পারে আপনার নিকট।]
একজন পিতা, যিনি ইসলামী ধর্মীয় লেবাসের কট্টর সমর্থক কিন্তু নৈতিক ও চারিত্রিকভাবে কঠোরভাবে ইসলামের বিরোধীতা করেন, তার একমাত্র মেয়ের প্রতি তিনি ছিলেন ধর্ষকামী মনোভাবের। মেয়েটি বুঝ হওয়ার পর থেকেই পরিবারে দেখেছে, তার মা কঠোর অত্যাচারের শিকার তার পিতা ও পিতার আত্মীয় স্বজন দ্বারা। এসব ঘটনায় মেয়ের মা নাকি এতটাই ভীত ছিলেন যে, তার পিতার বিরুদ্ধে আইনী ব্যাবস্থা নেওয়ার দুঃস্বাহস কোনোদিন করেননি। তীব্র ভয় আর পিতার প্রতি ক্ষোভ নিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েটি বুঝ হওয়ার সাথে সাথে লক্ষ্য করে যে, তার পিতা তার মা’কে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বলে, ‘মেয়েকে যদি আমার সাথে সঙ্গম করতে দাও তাহলে তুমি মুক্তি পাবে।’ ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটি ধর্ষিত হওয়ার ভয়ে, পায়জামা এত শক্ত করে বাঁধতো যে, অনেক সময় প্রস্রাবের বেগ পেলে সে পাজামা খোলার সময় পেত না, ফলে পাজামাতেই প্রস্রাব করতে বাধ্য হত। ২০১৭ সালে একদিন, মেয়ের মা’কে তার বাবা যখন খুব শারীরিক নির্যাতন করছিল, ভীত মেয়েটি তখন এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল আর তার শরীর শীতল হয়ে আসছিলো। সেই সময়ে মেয়েটির দাদি বলে উঠেছিলেন, ‘মেয়েকে তার বাবার কাছে দে, মেয়েকে শেষ করে দিয়ে এই ব্যাটা শান্ত হোক।’ তারপর থেকে মেয়ের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক আরও অনেকগুণ বেঁড়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন মেয়েটি উঠোনে খেলছিল। বেডরুম থেকে তার পিতা তার মা’কে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠায়। মেয়েটি বাবার রুমে গেলে, মেয়ের মা’কে বলা হয় রুম থেকে চলে যেতে। মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আমাকে কি ডেকেছিলেন?’ মেয়ের পিতা মেয়েটিকে খাটে বসতে বলেন। তারপর বলেন, আরও গায়ের সাথে লেগে বসতে। এরপর একটি মলম দেন মেয়ের হাতে। তারপর মেয়ের পিতা উলঙ্গ হয়ে বলেন, যাতে সারা শরীরে মলম দিয়ে মালিশ করে দেয়। ভীত মেয়েটি তখনও শাহস করে কোনো প্রতিবাদ করতে পারছিল না। মেয়েটি বাবার লজ্জাস্থান সহ সারাশরীরে মলম লাগায়। একই সময়ে, মেয়ের পিতা মেয়েকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি উত্তেজিত হলে যোনিতে পানি আসে কিনা’। প্রশ্ন শুনে মেয়েটি চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং খুব দ্রুত তার মা সহ তার নানার বাড়ি চলে যায়।
কিন্তু মেয়েটির উদ্বিগ্নতা কোনোভাবেই কমে না। নানার বাড়ির লোকেদের সাথে মিশতে গিয়ে সে বুঝতে পারে যে, তাকে সবাই একজন ধর্ষিতা হিসেবে জানে। একই কারণে তাকে সবাই হীন প্রতিপন্ন করে। হীনমন্যতায় ভোগা মেয়েটি যেকোনোভাবে চেয়েছিল তার আত্মীয়স্বজন ও পরিবার থেকে দূরে যেতে। তাই সে প্রথমবার কারো প্রেমে পড়ে। তারপর সেই ছেলের সাথে বিয়ের কথাবার্তাও ফাইনাল হয়। কিন্তু শেষে যখন ছেলের পরিবার মেয়েটির ব্যাপারে খবর নেয়, তখন তার পারিবারিক ইতিহাস জেনে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। এভাবে নাকি যতগুলো বিয়ের প্রস্তাব আসে, সবই ফিরে যায়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, একজন প্রতিবেশী নারীবাদী যুবককে একজন ২৪ বছরের তরুণীর করা সরল স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার বিবরণ। মেয়েটি আরও বলে যে, তার বাবার আরও তিন ভাই আছে, যারা যৌথভাবে একটি পাকা ঘর তৈরী করেছে। কিন্তু ঘরে তার বাবা উল্লেখযোগ্য ব্যায় করতে না পারায় এই ঘরে তার মা এবং সে সবসময় চাচিদের দ্বারা কটুক্তি ও বৈষম্যের শিকার হত। মেয়েটির এক ভাই প্রবাসে থাকেন, তবে আর্থিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই বলে মেয়েটি জানায়। এছাড়াও, তার বাবা-চাচারা এবং ভাই প্রবলভাবে গাঁজা সেবনে আসক্ত উল্লেখ করে মেয়েটি নিরাপত্তাহীনতা জনিত ভীতি প্রকাশ করে নারীবাদী যুবককে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
ঘটনাগুলো যেকোনো নারীবাদীর হৃদয়কে মূহুর্তেই ক্ষতবিক্ষত করা স্বাভাবিক। যুবকটি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে প্রথমে নারীটিকে তার একজন রাজনৈতিক বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়ে হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটি পড়তে উৎসাহিত করে। কিন্তু, মেয়েটি পড়ার চেয়ে নিজের গল্প বলাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতো- যা হীনমন্যতাবোধের অপরিহার্য পরিণতি। নারীবাদী যুবকটি মেয়েটিকে দ্বিতীয় প্রস্তাব দিয়ে বলে যে, মেয়েটি যদি পরিবার থেকে দূরে গিয়ে চাকরি করতে চায় তাহলে তার প্রথম মাসের বেতন পাওয়া পর্যন্ত তার সমস্ত ব্যায় যুবকটি বহন করবে। মেয়েটি রাজি হয়ে ফেনী শহরের একটি কাপড়ের শোরুমে চাকরি নেয়। বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে, মেয়েটি প্রতিদিন যুবকটির কাছে প্রকাশ করতে থাকে যে, সেই মেয়েটি যুবকটিকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং যেকোনো মূল্যে যুবকটিকে বিয়ে করতে চায়। একটি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে ছেলেটি প্রথমবার মেয়েটির প্রস্তাবে রাজি হয়ে তিনমাস সময় চায়।
এরমধ্যে যুবকটি প্রায়ই রিকশায় ও রাস্তায় মেয়েটিকে অন্য ছেলেদের সাথে ঘুরতে যেতে দেখায় মেয়েটির কথায় তার সন্দেহ হয়েছিল। একদিন মুভি দেখার অজুহাতে নারীবাদী যুবকটি মেয়েটির ফোন নেয় এবং খুব কম সময়ে যুবকটি নিজেকে বোকার স্বর্গে খুঁজে পায়। যুবকটিকে বলা একই ম্যাসেজগুলো সেই মেয়েটি একইসাথে ডজনেরও বেশি ছেলেকে পাঠাতো এবং তাদের সাথে নিয়মিত যৌনতাকেন্দ্রীক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। মেয়েটিকে এব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মেয়েটি প্রথমে জানায় যে, সে এসব ব্যাপারে কিছুই জানেনা। পরে মেয়েটির বেশকিছু অশ্লীল ছবি এবং ভিডিও তাকে যুবকটি দেখালে মেয়েটি নিশ্চিত হয় যে, যুবকটি সবকিছু জেনে গেছে। তারপর মেয়েটি স্বীকার করে যে, যখন সে একেরপর এক প্রেমে ব্যার্থ হচ্ছিল তখন তার মধ্যে যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল- সেই ক্ষোভবশত সে সারাদেশে কমপক্ষে ৩০ জন ছেলের সাথে ফিজিক্যালি এটাচ থাকতো। এরমধ্যে তার বয়সে ছোট বড় থেকে শুরু করে মামাতো ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, প্রতিবেশী, এবংকি কিছু কিছু সেলিব্রেটির সঙ্গেও তার এধরণের সম্পর্ক ছিল। প্রয়াত ফটোগ্রাফার ঋষি কাব্য (রিয়াজ), ইউটিউবার শামীম আহমেদ (মনা) সহ আরও অনেকেই তার এই অশ্লীল সম্পর্কের সঙ্গে নিয়মিত জড়িত ছিল। কখনো চট্টগ্রামের কোনো আবাসিক হোটেলে, কখনো ফেনী-কুমিল্লার আবাসিক হোটেলে, কখনো ঢাকার আবাসিক হোটেলে, কখনো পাহাড়ে-জঙ্গলে সে প্রায়ই ফিজিক্যালি এটাচ হত ফেসবুকে পরিচিত হওয়া যুবকদের সঙ্গে। এছাড়াও, তার নানুর বাড়িতে, তার মামাতো ভাইরা ছিল তার সবচেয়ে সহজলভ্য।
বিষয়গুলো নারীবাদী যুবকটির নিকট ছিল অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। সে আরও জানতে চাইলে মেয়েটি স্বীকার করে যে, প্রথমবার যখন সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, তখন সে ধূমপান করে তার খালাতো বোনের সাথে ঢাকার উত্তরায়এরপর এটা তার নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়। এব্যাপারে তাকে সহায়তা করতো তার দুই ফুফাতো ভাই। ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সে গাঁজা সেবন করতে গিয়ে তার মায়ের চোখেও পড়েছে বলে সে স্বীকার করে। কিন্তু এতসব ঘটনা নিয়ে তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ নেই। তবে, তার ভয় ছিল মানুষজন যদি এসব জেনে যায় তাহলে তার মানহানি হতে পারে। নারীবাদী যুবকটি বুঝতে পারে যে, দুই বছরের এত ভালোবাসার চ্যাটিং ছিল আসলে একজন পতিত নারীর ছলনা। মেয়েটির মধ্যে অনুশোচনার অভাব থাকায় যুবকটি এব্যাপারে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলে মেয়েটি জানায় যে- এসব ব্যাপার আসলে স্বাভাবিক, উদ্বিগ্নতা অযৌক্তিক। সে যুক্তি দেয় যে, তার খালাতো বোন, মামাতো বোন, চাচাতো বোন এবং অনেক বান্ধবীর একই ইতিহাস রয়েছে। একজন সরল প্রকৃতির পারিবারিক শোষণের শিকার নারীটি যেন একজন নারীবাদী যুবকের চোখে হয়ে উঠলো আত্মমর্যাদাহীন ও অবক্ষয়িত নৈতিকতাধারী একজন নারী। তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে তখন সে সরে আসতে চাইলেও, সে বিয়ের ঝুঁকি নেয় এই আশায় যে, একদিন নারীটির মধ্যে সত্যিকারের বিবেকবোধ জাগ্রত হবে এবং সে তার নৈতিক স্থলনের জন্য একদিন লজ্জা প্রকাশ করবে। তবে বিয়ের প্রায় এগারো মাস পরেও নারীটির নৈতিক ও মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি না দেখায় নারীটিকে নিয়ে নারীবাদী যুবকটি নতুন করে ভাবছে।
একজন নারী থেকে নারীবাদী যুবকটি প্রতারিত হয়েছে, এতে যুবকটির মন ভেঙেছে- কিন্তু তার চোখ খুলে গেছে। ফলে, এটাকে নারীবাদী যুবকটি একটি জয় হিসেবেই দেখে। নারীবাদী যুবকটি বলেন, ‘নারীদের উপর দমন-পীড়ন আসলে আবেগ কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যা আমি বিয়ের পর আরও ভালোভাবে বুঝেছি।’
পারিবারিক কলহের জেরে নারীদের উপর দমনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নারীর অধিকার আর নারীর কু-প্রবৃত্তি আলাদা জিনিস। নারীর অধিকার দমনের ব্যাপারটি নিন্দনীয়, কিন্তু নারীর কু-প্রবৃত্তি দমনের প্রচেষ্টা একটি নৈতিক দায়িত্ব। এটিকে আমরা নারীর উপর দমন-পীড়ন বলতে পারিনা। এটাকে বলা উচিৎ, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতার সংগ্রাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে নারী-পুরুষের আন্তঃসংঘাত হল মূলত আবেগ ও বিবেকের সংঘাত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে করেছে আবেগপ্রবণ আর পুরুষকে করেছে বিবেকপ্রবণ। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় রক্ষণশীল পরিবারে একজন পুরুষ সমাজকে মোকাবিলা করে- তাই সে বিবেচক হতে হয়, আর একজন নারী তার পরিবারকে মোকাবিলা করে- তাই সে কোমল, আবেগপ্রবণ ও ছলনাময়ী হতে হয়। তবে, একইস্থানে একইসাথে আবেগ ও বিবেক বিকশিত হতে পারেনা, তাই সমাজে প্রেমাষ্পদ, স্বামী-স্ত্রী অথবা নারী পুরুষের মধ্যে এটি একটি সুসম্পর্কের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। নিত্য কলহ এধরণের বাঁধার ফসল। তবে, মেয়েটির বাবা যা করেছে- অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয়, আইনী এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দানবিক আচরণ। অবশ্যই, এধরণের কর্মকান্ডের প্রতিরোধ করা উচিৎ সম্ভাব্য সব উপায়ে।’
পুরো ঘটনাটি দেখায় যে, একটি ছোট্ট কু-প্রস্তাব ধ্বংস করে দিতে পারে একটি স্বাভাবিক চিন্তাধারাকে। ধ্বংস করে দিতে পারে নৈতিকতার চর্চাকে, আত্মমর্যাদাকে এবং মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ‘লজ্জা’কে। তাই এব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিৎ সবার- সকল সকল ক্ষেত্রে চর্চা করা উচিৎ আত্মসংযমের।
কাজী তানভীর হোসেন,
লেখকঃ সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-সম্পর্কের গবেষক।