বিএনপি-জামায়াত জোটের সীমাহীন ষড়যন্ত্রে এই দেশ যতবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ততবারই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন রূপে ফিরে এসেছে প্রিয় দেশ। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি কখনো। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মিথ্যা মামলায় দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর, খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরপর ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। নির্জন কারাগের তখন কাউকে দেখা করতে দেখা হতো না তার সঙ্গে। অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রচণ্ড একাকী ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তবুও বিচলিত হননি। উল্টো ৩৩১ দিনের জেলজীবনে নিয়মিত ডায়েরি লিখে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প তৈরি করেছেন। যখনই কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, তিনি দেশবাসীর জন্য কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আবারো নির্বাচনের বিজয়ের মাধ্যমেই ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের খবর শুনেই প্রথম দিন দেশের চার জেলায় চারজন ব্যক্তি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। দেশজুড়ে প্রতিদিনই আন্দোলন-সংগ্রাম-প্রতিবাদ চলতে থাকে। এক সপ্তাহের মাথায়, ২০০৭ সালের ২৩ জুন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়।
দেশজুড়ে এই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী লুটপাটকারী ও ক্ষমতালিপ্সু বিএনপি-জামায়াত। তাদের দুঃশাসনের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, সংবিধান মেনে একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। কিন্তু অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল রাখতে, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির স্বজন ও সাবেক একজন বিএনপি নেতাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসানোর পাঁয়তারা করেন খালেদা জিয়া। এ ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগ। সংবিধান অনুসারে একজন নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে এই পদে বসানোর দাবি জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২৯ অক্টোবর রাতে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফলে সৃষ্টি হয় সাংবিধানিক সংকট।
এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই, বিএনপি-জামায়াতের হুকুমে ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করেন নির্বাচন কমিশন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দমনের উদ্দেশ্যে, ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের আদেশে দেশে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সাজানো নির্বাচনের ছক থেকে সরে না আসায়, ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। এরপর, ৫ জানুয়ারি, লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে আসন্ন একতরফা নির্বাচনকে অর্থহীন বলে অভিহিত করা হয়।
এদিকে দেশজুড়ে উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেয় সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে তিন বাহিনীর প্রধান এবং আরো কিছু সেনাসদস্য বঙ্গভবনে যান। তাদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেই রাতেই ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করেন তারা। এরপর ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের সামনে রেখে, সরকার পরিচালনা করতে থাকেন মইন ইউ আহমেদ এবং সামরিক সদস্যরা। এরপর রাজনীতিবিদদের গণগ্রেফতার করে, দীর্ঘমেয়াদে দেশের ক্ষমতা দখলের ছক আঁকেন তারা। দেশজুড়ে বেজে ওঠে অশুভ ঘণ্টা। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ নেত্রী শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্জন কারাগারে বন্দি করে কৌশলে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়।
২০০৭ সালের সেই আগস্টজুড়ে ভয়ানক বন্যা শুরু হয় দেশে। সেসময় চিকিৎসাহীন অবস্থায় জেলে দিন কাটাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। আইনজীবীরা মামলার ব্যাপারে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তিনি তাদের মাধ্যমে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। এমনকি যে সরকারের রোষানলে তাকে জেলে বন্দি থাকতে হচ্ছিলো, গণমানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সেই সরকারকেও সহযোগিতা করতে বলেন তিনি। নেত্রী বলেন, ‘এবারের বন্যা ১৯৯৮ এর চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকারের একার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নাহলে বন্যা সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে।’ কারান্তরীণ থেকেও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি ব্যাপকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেন তিনি। শেখ হাসিনা এ কারণেই অনন্য, গণমানুষের প্রয়োজনে নিজের জীবন ও রাজনীতিকে তুচ্ছ করতে পারেন তিনি।
এদিকে গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কান ও চোখের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন নেত্রী। কিন্তু তাকে উন্নত চিকিৎসা থেকে বিরত রাখা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের মার্চের শেষ দিন আদালতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি আইনজীবীদের বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পারিনি। এখন বিনাচিকিৎসায় মারার চেষ্টা করছে।’ এসময় তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালে সন্তানসম্ভবা ছিলাম। পাকিস্তানিরা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে দেখা করতে দেয়নি। এখন এরা চিকিৎসাসেবা ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না। আমার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে, তার ভার আমি আল্লাহ ও জনগণের ওপর দিচ্ছি।’
সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় সময়ের সাথে সাথে অসুস্থতা বাড়তে থাকে নেত্রীর। অবশেষে তাকে হাসপাতালেও থাকতে হয় প্রায় তিন সপ্তাহ। ২০০৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, আদালতে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুরুতে রাজনীতিবিদদের যেভাবে হয়রানি শুরু করেছিল, সেই পরিস্থিতি সামলাতে কিছুটা সময় লাগে নেতাকর্মীদের। এই সময়েও সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে নিয়মিত শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। ২৭ ও ২৮ মে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেফতার। প্রায় ২০ হাজার কর্মীকে আটক করা হয়। কিন্ত তবুও দমানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর ব্যক্তিত্বের সামনে সেনাসমর্থিত সরকারের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। তারা শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয় বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে। এমনকি গাড়িতে করে তার বাসভবন সুধাসদনে পৌঁছে দিয়ে আসা হয় তাকে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়েই বাংলার মানুষের ভাগ্য বদলের উদ্যোগ নেন তিনি। ‘দিন বদলের সনদ’ নামে নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেন। কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নিখুঁত পরিকল্পনার প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল এটি। নিঃসঙ্গ জেলে বসে দেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ইশতেহারের রূপকল্প তৈরি করেন শেখ হাসিনা।
জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বের গুণে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে, ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে টানা তৃতীয় বার ও মোট চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার পুরো মেয়াদকালে এই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ করেন তিনি। সমৃদ্ধির পথ ধরে দেশ এখন এউন্নত বিশ্বের দিকে ধাবমান।