তারাবি মাহে রমজানের রাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ আমল। এ মাসের অবারিত খায়র-বরকত, রহমত-মাগফিরাত লাভের ও ঘোষিত প্রতিদানপ্রাপ্তির জন্য তারাবির প্রভাব অপরিসীম। এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৭, আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৭১)
👉 তারাবির বৈশিষ্ট্য–
তারাবির নামাজ সুন্নতে মুআক্কাদা হলেও তা অন্য সুন্নতের মতো নয়। এর জন্য ফরজ নামাজের মতো জামাত বিধিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি এর জন্য আলাদাভাবে ইমামও নিয়োগ দেওয়া হয়। সিংহ ভাগ মসজিদেই তারাবিতে পুরো কোরআন মাজিদ খতম করা হয় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। পাশাপাশি তারাবিকে শিআরে রমজান তথা রমজানের বিশেষ পরিচয় চিহ্নও বলাও যায়। কারণ রমজান ছাড়া অন্য কোনো সময় ইশার নামাজের পর এভাবে জামাতের সঙ্গে উঁচু আওয়াজে কিরাত পড়ে কোনো নামাজ আদায় করা হয় না। সুতরাং এশার নামাজের পর জামাতের সঙ্গে উঁচু আওয়াজে কিরাত পড়ে নামাজ আদায় করা এই বার্তা দেয় যে এখন রমজান মাস। এ থেকে বোঝা যায়, তারাবির গুরুত্ব সাধারণ নফলের চেয়ে অনেক বেশি।
👉 রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তারাবি–
রাসুলুল্লাহ (সা.) তারাবির জামাত নিয়মিত পড়াননি; বরং কখনো কখনো তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়িয়েছেন। আবার কখনো কয়েক রাকাত জামাতের সঙ্গে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন এবং বাকি নামাজ একাকী পড়েছেন; বরং বেশির ভাগ সময় তারাবির নামাজ তিনি একাকীই পড়তেন। তিনি নিজে কেন তারাবির জামাতের নিয়ম করেননি তার কারণও উম্মতকে বলে গেছেন। সেই কারণ হলো, তিনি নিয়মিত জামাতের সঙ্গে তারাবি পড়লে তা ফরজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আয়েশা (রা.) বলেন, রমজানের এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বের হয়ে মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ পড়া শুরু করলেন। ইতিমধ্যে কিছু সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে ইক্তিদা শুরু করলেন। সাহাবায়ে কিরামের মাঝে এ বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে পরদিন তারাবিতে আরো বেশিসংখ্যক সাহাবি তাঁর পেছনে ইক্তিদা করলেন। তৃতীয় দিন সাহাবায়ে কিরামের সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। চতুর্থ দিন মসজিদে আর জায়গার সংকুলান হলো না। এ দিন তিনি ফজরের নামাজ আদায়ের পর সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, ‘হামদ ও সালাতের পর, তোমরা শোনো, তোমাদের অবস্থা আমার অজানা নয়। কিন্তু আমার ভয় হয়, এভাবে চলতে থাকলে তোমাদের ওপর তারাবির নামাজ ফরজ হয়ে যেতে পারে। তখন তোমরা তা আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়বে। [ফলে ফরজ ছেড়ে দেওয়ার গুনাহে সবাই জড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কায় সবাই মিলে জামাতে তারাবি পড়ার ব্যবস্থা আর করা হলো না।] তারাবির নামাজ এ অবস্থায় রেখেই রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকাল করেন। (বুখারি, হাদিস : ২০১২, মুসলিম, হাদিস : ১১০৪)
👉 তারাবির জামাত–
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে, ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে এবং উমর (রা.)-এর শাসনামলের শুরুতে এক ইমামের পেছনে ফরজ নামাজের মতো তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তী সময়ে রমজানের কোনো রাতে উমর (রা.) মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখলেন মসজিদের বিভিন্ন স্থানে তারাবির খণ্ড খণ্ড জামাত হচ্ছে। কেউ বা আবার একাকী তারাবি আদায় করছে। এ অবস্থা দেখে তিনি চিন্তা করলেন সবাইকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দিলে অনেক উত্তম হবে। এরপর তিনি এক ইমামের পেছনে তারাবির জামাত পড়ার ফরমান জারি করলেন এবং সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে তারাবির জামাতের ইমাম বানিয়ে দিলেন। (বুখারি, হাদিস : ২০০৯, ২০১০)
কোনো সাহাবি এর বিরোধিতা করেননি। এরপর থেকে সূত্র পরম্পরায় তারাবির নামাজ জামাতবদ্ধভাবেই চলে আসছে। কাজেই এ নিয়ে অযথা বির্তক সৃষ্টি বা হট্টগোল পাকানো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
👉 তারাবির রাকআত সংখ্যা–
তারাবি মূলত ২০ রাকাত, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস, সাহাবায়ে কিরামের ইজমা, পরবর্তী সব তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, মুজতাহিদ ইমামদের আমল ও ইজমার দ্বারাই প্রমাণিত। (দেখুন, আল মুগনি, ইবনে কুদামা : ২/১২৩)। সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) রমজানে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়তেন এবং বিতর আলাদাভাবে পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৭৬৯২, ৭৬৮০-৭৬৮৪; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি, হাদিস : ৪২৯০-৪২৯২; আল মুজামুল কাবির, তাবরানি, হাদিস : ১২১০২)
ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) ছিলেন প্রথম সারির একজন বিখ্যাত তাবেঈন, হাদিস, ফিকহ ও তাফসিরের ইমাম। তিনি ২০০ সাহাবিকে সরাসরি দেখেছেন। (দেখুন, তাহজিবুল কামাল : ১৩/৪৯)। তিনি বলেন, আমি সাহাবা ও প্রথম সারির তাবেঈনদের দেখেছি, তাঁরা ২০ রাকাত তারাবি ও ৩ রাকাত বেতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৭৬৮৮)। সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে তারাবির ইমাম নিযুক্ত করার পর থেকে মসজিদে নববীতে তিনি প্রকাশ্যে ২০ রাকাত তারাবি পড়াতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৭৬৮৪)
সেই জামাতে উমর (রা.), উসমান (রা.), আলী (রা.)সহ মদিনায় উপস্থিত সব সাহাবি অংশগ্রহণ করতেন। আর তখন প্রায় সব সাহাবি মদিনায় উপস্থিত ছিলেন। কোনো কোনো সাহাবি মদিনার বাইরে থাকলেও মদিনা ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ায় তার সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এ অবস্থায় কোনো সাহাবি ২০ রাকাত তারাবির বিরোধিতা করে কথা বলেননি।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলুম তালতলা মোমেনশাহী ও মাদরাসা ছাওতুল হেরা, মাইজবাড়ী, মোমেনশাহী