৭৫ তম বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এইবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “সমতা, স্বাধীনতা ন্যায় বিচার”। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থেকে মানবাধিকারের জন্ম হয়েছে। আর সেই শ্রদ্ধাবোধ শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। সহজ কথায় মানবাধিকার হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানুষের অধিকার। মানব অধিকার হলো একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকার। ব্যক্তির ভালো থাকা, খাওয়া-পরা, অন্যের জুলুম থেকে নিরাপদ থাকা, কেউ কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা এবং ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিকে সম্মান করার অর্থ মানবাধিকার। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যেসব অধিকার লাভের দাবিদার সেসব অধিকার সংরক্ষণ করার নাম মানবাধিকার। মানবাধিকার হলো ব্যক্তির নিরাপত্তা ও নিরাপদ জীবনের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক নীতিমালা দ্বারা স্বীকৃত। মানবাধিকার মানবের গুণাবলি সংরক্ষণ ও নিরাপদ জীবনের অধিকার। মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন : খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানবাধিকারের আওতাভুক্ত। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ, ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। মানবাধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় এবং সেই থেকে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ এ আন্তর্জাতিক দলিলটির মূল খসড়া তৈরি করেন কানাডার প্রফেসর জন হামফ্রে। এ কাজে আরো যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা হলেন এলিনিয়র রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), রেনে ক্যাসিন (ফ্রান্স), পি সি চাঙ্গ (চীন)-সহ অন্য ব্যক্তিরা। ৩০টি অনুচ্ছেদসংবলিত এ দলিলটি মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর বিজ্ঞপ্রণেতারা বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের সংমিশ্রণ ঘটান। যদিও এ ঐতিহাসিক দলিলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণযোগ্য কোনো দলিল নয়, তবু এটা সত্য, এটি মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দলিল ও কনভেনশনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রটি মোট ৩৩০টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে, যা ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ অনুযায়ী একটি বিশ্বরেকর্ড। অন্য কোনো দলিল বা গ্রন্থ বিশ্বের এতটি ভাষায় অনূদিত হয়নি। (সূত্র : ইন্টারনেট)।
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’। কিশোর কবি সুকান্ত এখানে মানবাধিকারের কথাই তুলে ধরেছেন। শিশুর জন্মের অর্থই হলো এ পৃথিবীতে তার বাঁচার অধিকার আছে। আর বাঁচতে গেলে তাকে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে, তার স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার, স্বাধীনভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক প্রভৃতি অঙ্গনে বিচরণ করার। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মলাভ করে ব্যক্তি সমাজ জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থায় তথা বিশ্ব পরিসরে যেসব সুযোগ-সুবিধার দাবিদার হয়, যা ব্যতীত ব্যক্তিজীবনের স্বয়ংসম্পূূর্ণতা আসে না, সেসব সুযোগ-সুবিধাই মানবাধিকার। এসব সুযোগ-সুবিধা মানুষের জন্মগত ও প্রকৃতিগত অধিকার। চন্দ্র-সূর্যের আলো যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে সমভাবে স্পর্শ করে, ঠিক তেমনি মানবাধিকার পৃথিবীর সব মানুষকে সমভাবে স্পর্শ করবে। মানবাধিকার সর্বজনীন এবং ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার। মানবাধিকার ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য বা ব্যক্তি জীবনের পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য অপরিহার্য। মানবাধিকার লঙ্ঘন করা উচিত নয়। মানুষের এ অধিকার খর্ব করা হলে মানব মনের অপমৃত্যু ঘটে।
আইএলও এবং ইউনিসেফের সহায়তায় ‘বাংলাদেশের শিশু পরিস্থিতি’ নামক এক গবেষণায় (রহমান, ১৯৯৭) দেখা যায়, শিশুরা প্রায় ৩০০ রকমের পেশায় জড়িত। এর মধ্যে ৪৭টি পেশা ঝুঁকিপূর্ণ বলে আইএলও চিহ্নিত করেছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ফলে অল্প বয়সের শ্রমিকরা অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশা শিশুদের বেড়ে ওঠাই কেবল ব্যাহত করে না, তাদের জীবনও বিপন্ন করে। দেশের প্রতি ১০ জন শ্রমিকের একজনের বয়স ১৪ বছরের নিচে এবং এদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শিশুশ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, বেতন নামমাত্র, বিশ্রাম নেই, খেলাধুলা নেই, এমনকি চিত্তবিনোদন কিংবা স্কুলও নেই, আছে সামান্য কারণে ‘ওস্তাদের’ চড়-থাপ্পড় আর খিস্তিখেউড়। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারিরা মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্য আনা-নেওয়ায় নিয়োজিত করে কোমলমতি শিশুদের। বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশু পাচার বর্তমানে তুঙ্গে উঠেছে। পাচারকারী চক্র জীবিকার নানা লোভনীয় প্রস্তাবে এদের প্রলুব্ধ করে ঠেলে দেয় এক অন্ধকার জগতে। সীমান্ত এলাকার অবুঝ শিশুদের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজি দিয়ে চোরাচালান কাজে উৎসাহিত করছে। এ ছাড়া অভাবের তাড়নায় অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের চোরাচালানিতে সম্পৃক্ত করছে। আমাদের দেশ থেকে অনেক নারী ও শিশু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। ছোট ছেলে শিশুদের পাচার করে সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পাঠানো হয়। সেখানে তাদের উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ছোট শিশু এ কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়। অনেকে মারাও যায়। এ ছাড়া মেয়েশিশু ও মহিলাদের বিদেশে কাজের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়।
একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও হরিজনরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাত-পাতের প্রথা এবং বর্ণবৈষম্যের বিষয়টি এখনো সমাজে বর্তমান। অনুমান করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৫৫ লাখ দলিত ও হরিজন জনগোষ্ঠী রয়েছে। দলিত, হরিজন বা অন্ত্যজন যে নামেই ডাকা হোক না কেন, একটি ক্ষেত্রে তা অভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। সেটি হচ্ছে এরা অস্পৃশ্য, অচ্ছুত, ঘৃণ্য এবং সমাজের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের ওঠাবসা নেই। অর্থাৎ সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে এসব মানুষের প্রতি। তাই যারা সমাজসংস্কারক তারা এদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন। যেমন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘হরিজন’ বা হরির পুত্র বা ঈশ্বরের সন্তান; বাবা আন্বেদকার বলেছেন, দলিত। এসবই করা হয়েছে মানুষ হিসেবে তাদের তুলে ধরার জন্য। বাংলাদেশে এই দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে নরবিদাস. ঋষি, হরিজন, শব্দকর, বেহারা, বেদে, কাওরা, জলদাস, নিকারী, শিকারী, চৌদালী, দাই, হাজাম, শাহজী, তেলি, ধোপা, মানতা, নাগারচি, নমঃশূদ্র এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র পেশাজীবী গোষ্ঠী।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বিপর্যয়কর, ঘৃণ্য এবং অনৈতিক এই অবকাঠামোর ফলে ওইসব অবহেলিত সমাজবিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এই সভ্য ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা, বঞ্চনা আর ঘৃণায় জর্জরিত। এসব জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যপীড়িত বলে অস্পৃশ্য নয়, বরং অস্পৃশ্য বলেই দারিদ্র্যে নিপতিত। ঐতিহাসিকভাবে দলিত ও হরিজনরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করলেও তাদের কাজ ও পেশা নিশ্চিত ছিল। বর্তমানে হয় সেই পেশার অস্তিত্ব নেই (যেমন পালকি বহন), অথবা থাকলেও বর্তমানে কর্ম নিশ্চিত নয়; কিন্তু বিচ্ছিন্নতার ফলে সামাজিক অস্পৃশ্যতা থেকেই গেছে। তাদের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য একটি জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি এবং ওই উন্নয়ননীতি বা অন্তর্ভুক্তকরণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের উন্নয়ন তখনই সফলভাবে হবে, যখন তারা স্থানীয় ও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাই জাতীয় সংসদসহ সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এসব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবেÑমানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক অনাচার, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে। শান্তি ও উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে সমাজে সর্বত্র মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুখী-সমৃদ্ধ-শান্তিকামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সবার আগে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হোক সবার জীবন।
লেখকঃ
সমন্বয়ক, চট্টগ্রাম বিভাগ
ল’ এন্ড জাস্টিস ফাউন্ডেশন (এলজেএফ)
আইন,বিচার এবং মানবাধিকার সংগঠন
(গভঃ রেজিঃ-১১৩২৭)