পলাশ সেন। চট্টগ্রাম মহানগর প্রতিনিধি
চট্টগ্রামে এবার ইস্টার্ন ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে এক গ্রাহকের ৬ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তরা গ্রাহকের চেক নিজেদের হেফাজতে রেখে বিভিন্ন সময় চেকে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করেছেন।
২০১৯ সালে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও চলতি মাসের ২ জুন ইস্টার্ন ব্যাংক ও একই মাসের ৯ জুন দুদকের বরাবরে ভুক্তভোগী গ্রাহক মো. আনোয়ার ইসলাম ভূঁইয়া এই ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন।
অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন- ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার হেড অব রিলেশন ইউনিটের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম, একই শাখার হেড অব কর্পোরেট ব্যাংকিং সঞ্জয় দাশ ও শাখা ব্যবস্থাপক।
ভুক্তভোগী গ্রাহক হলেন- কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার আনোয়ার ইসলাম ভূঁইয়া। নগরীতে তিনি পূর্ব নাসিরাবাদে পরিবার নিয়ে থাকেন। শাহ আমানত কাটিং সেন্টার, আলাইসা স্টীল, আদিয়ান স্টিল, শাহ আমানত ট্রেডিংসহ অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
ভুক্তভোগী গ্রাহক অভিযোগে বলেছেন, ২০১২ সালে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত কাটিং সেন্টারের নামে একটি লোন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইস্টার্ন ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবলী রোড শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা ঋণ নেন। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি এই ঋণ নেন। এসময় ব্যাংকে মর্টগেজ হিসেবে তাঁর চট্টগ্রামের তিনটি জায়গা ও একটি ফ্লাট এবং ঢাকার একটি জায়গা দেখান।
ঋণ গ্রহণের পর তিনি প্রতিমাসে লোন পরিশোধ করে আসছিলেন। ২০১৮ সালে অভিযুক্ত আজহারুল ইসলাম আগ্রবাদ কর্পোরেট শাখায় বদলি হলে তিনি গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নিজ উদ্যোগে ওই শাখায় স্থানান্তর করেন।
২০১৯ সালে জানুয়ারীতে ভুক্তভোগী গ্রাহকের চেক বই শেষ হয়ে গেলে পরে তিনি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় গিয়ে নতুন চেক বইয়ের জন্য ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।
অভিযুক্ত আজহারুল তখন গ্রাহককে বলেছিল তিনি চেক বই আগেই তৈরি করে রেখেছেন। এরপর তাঁর হাতে চেক বই তুলে দিলে বইয়ের ১৯টি পেজে ভুক্তভোগী গ্রাহকের স্বাক্ষর জাল করে ৬ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাত করার বিষয়টি ধরা পড়ে। ২০১৯ সালে জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এসব টাকা তোলা হয়।
ভুক্তভোগী গ্রাহক অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, সাধারণত টাকা লেনদেন সংক্রান্ত মোবাইলে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে গ্রাহককে অবগত করা হয়। কিন্ত গ্রাহকের কাছে টাকা উত্তোলন সংক্রান্ত কোনো ম্যাসেজ আসেনি।
এই বিষয়ে ওই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো সুদুত্তর না দিয়ে বিষয়েটি সমাধান করে দিবে বলে জানায়। এছাড়া ম্যাসেজ না আসার বিষয়ে তাঁদের সার্ভার সমস্যা হয়েছিল বলে ভুক্তভোগী গ্রাহককে জানায়।
পরে ওই কর্মকর্তা নানা অজুহাত ও প্রতারণার মাধ্যমে পুরোনো লোন হিসাবটি বন্ধ করে তাঁকে দিয়ে তিনটি নতুন হিসাব খোলান।
গ্রাহক অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত আজহারুল ইসলাম নানা অজুহাতে তাঁকে ব্যাংক লোন থেকে পরিত্রান না করে গৃহীত লোনটি রিশিডিউল করেন। এমনকি গ্রাহকের অজান্তে তাঁর ব্যাংকে রক্ষিত ৭০ লক্ষ টাকার এফডিআরের ১ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা ঋণের বিপরীতে সমন্বয় করা হয়েছিল।
পরে তিনি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে ও চলতি মাসের ২ জুন ব্যাংকটির চট্টগ্রাম শাখা ও প্রধান অফিসে অভিযোগ দায়ের করেলও এই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগে বলা হয়।
আনোয়ার ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ২০১৯ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ার পর আমি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলার সাহস পাইনি। ব্যাংকটিতে আমার লোন অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাঁরা কখন কী করে ফেলে তা নিয়ে ভয় কাজ করছিল। কারণ ব্যাংকটিতে আমার সম্পত্তি মর্টগেজ রাখা আছে। অভিযুক্তরাও সমাধান করে দিবে বলে ঘোরাতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে।
জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়টি সমাধান না হওয়ায় ২০২৩ সালে আমার পরিচিতজনদের পরামর্শে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ও প্রধান অফিসে অভিযোগ দায়ের করি। পরে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করি। এরপর থেকে অভিযুক্তরা আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়। আমাকে ফোন করে আমার মৃত মাকে নিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও প্রাননাশের ভয়ভীর্তি করাসহ তাঁদেরকে কিছু করতে পারবে না বলে হুমকি দেয়।
ঘটনাটি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় থানায় আর জিডি করতে যায়নি। দুদকের তফশীলভুক্ত অপরাধ হওয়ায় পরে আইনজীবীর পরামর্শে ৯ জুন দুদকের বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করি।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে তিন কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর তা রোলিং হতে হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে তাঁর ১০ কোটি টাকা লোন দাঁড়ায়। এসময় ২০২৩ সাল পর্যন্ত লোনের বিপরীতে সুদ হিসেবে প্রায় ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। বর্তমানে আমার ব্যবসা বাণিজ্য পথে বসেছে। এমন সময়ে প্রায় সাত কোটি টাকার এমন জালিয়াতির বিষয়ে আমি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।