বাংলাদেশের সূচনালগ্ন হতে জন-সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এদেশের জনগণ সহ বিশ্বের বহুদেশ স্বোচ্চার হয়ে উঠেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এই পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু এদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বহির্বিশ্ব সহ এদেশের সাধারণ জনগণের স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে ‘জনসমস্যার সমাধান’ এর অস্পষ্ট কথাটি অনেক কল্পনা-জল্পনার জাল বুনে চলেছে। কল্পনা-জল্পনা যেকোনো প্রয়োজনীয় সমাধানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে সমস্যাকে জটিলতর করে তোলে। কাজেই, জনসমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে এদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
আমরা যারা রাজনীতি-অর্থনীতির চ্যাপ্টারগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব উপলব্ধি করতে পারি – যারা জনসমস্যার কারণ-স্বরুপ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে দ্বায়ী করি – যারা মনে করি সাংস্কৃতিক সমস্যাও অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, তারা মনে করি সমস্যাগুলো সমাধানের পথ বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনর্গঠনের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এর-ই মানদন্ডে আমরা জানি যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের গাঠনিক কাঠামো, অর্থাৎ বাহাত্তর সালের সংবিধানের মূলনীতি এখনও প্রাসঙ্গিক। পৃথিবীর কাছে অজানা নয় যে আওয়ামী লীগ এর ইতিহাস হল গণমুক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির ইতিহাস। তবু কেন আজ আওয়ামী লীগ বারবার দেশের বিরোধী দল সমুহের জঙ্গি-কার্যক্রমের শিকার হতে হচ্ছে এর সদুত্তর পেতে হবে।
বাংলাদেশের জনসমস্যার মৌলিক কারণগুলো এড়িয়ে গিয়ে কোনো সমাধানের চেষ্টা করা হলে এর স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবেনা। তাই, যাঁরা জনসমস্যার সমাধানের গরম গরম বক্তৃতায় কোমল হৃদয়টিকে বিক্ষিপ্ত করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছেন, তাদের কাছে সংগ্রামের সার্বিক দিকটি স্পষ্ট থাকতে হবে।
অর্থনীতি তার বিকাশের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় একটা পর্যায়ে গিয়ে এটি সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে এবং এটিকে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের এই নমুনা বিশ্বব্যাপী দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রুজভেল্ট-চার্চিল আর স্ট্যালিনরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংক আইএমএফ গঠন করে। কিন্তু ২০০৮ হতে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা তাদের পরিকল্পনাগুলোকে নস্যাৎ করেছে। তাই মুক্তিকামী জনগণ বুঝতে হবে, বিদ্যমান জনসমস্যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যার আবশ্যকীয় ফল। কাজেই এর সমাধান কোনো ব্যাক্তিবিশেষের কিংবা দল বিশেষের কাজ নয়। এখন প্রয়োজন বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর। গোটা পৃথিবী সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু অজ্ঞতায় ভরা দেশসমূহে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। ঝড়ের সময় সবাই ঘরে ঢোকে না ; কেউ কেউ আম কুড়াতেও বের হয়। সরকার যখন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়, তখনই দেশের সুযোগসন্ধানী স্বার্থপর গোষ্ঠী রাজনৈতিক ঝড়কে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পায়তারা করে। বিদ্যমান ক্রাইসিসে সাধারণ জনগণের বিক্ষুব্ধতাকে কাজে লাগিয়ে নানান ভাবাদর্শের ছলাকলা দেখিয়ে তাদের মধ্যে একটা অন্ধ প্রেরণা সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে জনগণকে দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে বিরোধী দলগুলো একটা হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করে গোটা দেশকে কসাইখানায় পরিণত করে।
আইএমএফ গঠিত হওয়ার পর বিশ্বায়নের সুস্পষ্ট ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রবহমান রাজনীতি-অর্থনীতি ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই বর্তমানের স্থানীয় রাজনৈতিক সমস্যাও বৈশ্বিক সমস্যার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একারণেই বৈশ্বিকভাবে পরিকল্পিত উদ্যোগ ব্যাতিত এর সমাধান পাওয়ার কোনো পথ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ডজন ডজন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম করে আসছে। এসব কার্যক্রমের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। নেই বলেই এইসব মূলত সন্ত্রাসী-কার্যক্রম। জনগণের স্বার্থে গণমুক্তির রাজনীতির বিপরীতে তারা বাসে আগুন দিচ্ছে, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করছে, নানান গুজব তুলে দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি, সারাদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাঞ্চিত করছে এবং দেশব্যাপী ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে চলেছে। এই সুরে সুর মেলাচ্ছে আবেগগ্রস্ত সরল জনগণ। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি বিএনপি জনগণকে এইসব আবেগী কথায় উৎসাহ দেয়। জন্মলগ্ন থেকে বিএনপি-জামাত এইসব অতি-উৎসাহী জনগণকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে আসছে। আত্মমর্যাদার কবরে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে তারা দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী কুৎসা রটানো অব্যাহত রেখেছে। মিথ্যার মোহে জনগণকে মোহগ্রস্ত করে তারা নানান সময়ে ক্ষমতায় আসার পায়তারা করেছে। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল বুঝে এদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা বহির্বিশ্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ অনধিকার চর্চা করে চলেছে। কিন্তু আমরা রাজনীতি সচেতন ব্যাক্তিবর্গ বাস্তব, মুক্তিবাদী ও যুক্তিবাদী, তাই ভাবাবেগ’কে প্রশ্রয় দিইনা। বিরোধী দলগুলোর উপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। জন্মলগ্ন থেকে গণমুক্তির বিরোধী শক্তি বিশেষত জামাত-বিএনপি গণমানুষের যে ক্ষতি করেছে তার নৈতিক বা আইনগত যেকোনো বিচারে আমরা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারি। কিন্তু আমরা এও জানি, এই ক্ষতি পূরণের সাধ্য বিএনপির নেই। শুধুমাত্র এই অপরাধেও বিএনপিকে নির্মূল করা যৌক্তিক। জনগণের অজ্ঞতাই বিএনপির রাজনৈতিক শক্তির উৎস। তাই বিএনপিকে নির্মূল করতে শিক্ষার যত তাৎপর্য আছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর মূলনীতি “শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি”র তাৎপর্য তার চেয়ে বেশি আছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ : এ দুইয়ের স্ট্যাকচারের মধ্যে পার্থক্য জানলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জামাত-বিএনপি সহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর করা অভিযোগের কোনো ভিত্তি থাকেনা৷ আওয়ামী লীগ ব্যাক্তি নয়, একটি কাঠামোর নাম। একটি সংগঠিত সংগ্রামের পদ্ধতির নাম। সর্বোন্নত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে গণমুক্তির রাজনীতি জিইয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র। কাজেই এই গঠনতন্ত্র দূর্নীতিমুক্ত। কাজেই আওয়ামী লীগের প্রতি দূর্নীতির অভিযোগ প্রথমত মিথ্যা, আর মিথ্যা বলেই অন্যায়। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী ব্যাক্তিবর্গের ব্যাক্তিগত কাজের পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা আওয়ামী লীগের সীমাবদ্ধতা নয়। বিএনপির রাজনীতি করা আর চরিত্রের সার্টিফিকেট পাওয়া ভিন্ন ব্যাপার। বিএনপির স্ট্যাকচার সহ তার সম্পূর্ণ ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বিএনপি এবং তার নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণরূপে অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে হাওয়াই যুদ্ধ করে। কাজেই, আজ ফখরুল-রিজভী গং জবাব দিতে হবে, জড়বুদ্ধিতাসুলভ অন্যায় কার্যক্রমই কি তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কিনা। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে জড়বুদ্ধিতা প্রতিহত করে। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে অন্যায় প্রতিহত করে। কাজেই আওয়ামী-ফ্যাসিজম নামে ব্যাপকভাবে প্রচারিত কুৎসাটি মূলত আওয়ামী লীগের অন্যায় নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। একারণেই আওয়ামী লীগ আরও বেশি যৌক্তিক।
ঐক্যবদ্ধ বাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উর্ধ্বে গিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর এর গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ সহ দেশব্যাপী দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সচেষ্ট ছিল। আজ আবারও ঐক্যবদ্ধ জনগণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উর্ধ্বে উঠতে হবে মুক্তির বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রতিহত করতে। এটা ইতিহাস। ইতিহাসের শিক্ষা। তাই আজ আবার দীপ্ত কণ্ঠে স্লোগান ধরতে হবে “একাত্তরের হাতিয়ার – গর্জে উঠুক আরেকবার”। পৃথিবীর সভ্য মানুষ মাত্রেই ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানিকে ঘৃণা করে। জামাত-বিএনপি নিজেদেরর অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে হাতিয়ার স্বরুপ এই সাম্প্রদায়িকতাকে একটি প্রধান অবলম্বন হিসাবে বেছে নেয় প্রতিবার। তাদের চেহারায় রাজাকারের ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই আজ নির্ধারণ করা আরও সহজ — রাজাকারের জাতক কারা। ১৯৫২ সালের ও ১৯৫৪ সালে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন ও আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাবে কিছু কালের জন্য রাজাকারদের চক্রান্তের সমাধি রচিত হয়েছিল। কিন্তু আজ আবারও রাজাকারের জাতকেরা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে দেশব্যাপী। কথায় কথায় হরতাল অবরোধ দিয়ে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে রসাতলে পাঠিয়ে দিয়েছে। পুরো দেশে ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক দিয়ে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে ভূত-প্রেতের মতো এই জামাত-বিএনপি নাচছে। বিপরীতে এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গোটা বিশ্বে মন্দার যুগেও নিজেদের অঞ্চলকে এখনও তুলনামূলক সমৃদ্ধ অবস্থানে ধরে রেখেছে। এর বাস্তব প্রভাবের স্বাক্ষী সেইসব রাজাকারের জাতকেরাও। কাজেই পুরোনো স্লোগানগুলো আবারও সচল করে তুলতে হবে। চিৎকার করে বলতে হবে “জামাত-শিবির রাজাকার – এই মূহুর্তে বাংলা ছাড়!”
বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। এই অর্থনীতিকে সঠিক কাঠামোয় পুনর্গঠিত করতে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার তাৎপর্য থেকে বাহাত্তর সালের সংবিধানের কোনোভাবেই পৃথক নয়। আর, বাহাত্তর সালের সংবিধানের সাথে আওয়ামী লীগের গাঠনিক ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য। কাজেই আজ আওয়ামী লীগের তাৎপর্য বুঝতে হলে বুঝতে হবে মন্দার যুগে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে গণমুক্তির তাৎপর্য। তাই বাংলাদেশের একমাত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করা গণমুক্তির জন্য অপরিহার্য শর্ত। ভয়-ভীতি, ত্রাস, ঘৃণা, অবিশ্বাসের মধ্যে সহযোগিতা হতে পারেনা। কাজেই কথার ফানুস দিয়ে নয়, প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবার সারাবাংলায় বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। জনগণ আর কোনো সন্ত্রাসী-সমাধান গ্রহণ করবে না। তাই বিরোধী দলের সমর্থকেরা খোলা মনে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে হবে, এবং আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করতে হবে।
লেখকঃ
অপিনিয়ন কলামিস্ট এবং পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট