নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
আনোয়ারা উপজেলার সৌদি আরবে অবৈধ অভিবাসী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি চক্রের ডন আলী আকবর। পাসপোর্টের জন্য ভুয়া সব কাগজপত্র বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ করেন তার দুই ভাই মামুন ও আরমান। জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজশে এসব পাসপোর্ট বানানো হচ্ছে। প্রতিটি পাসপোর্টের বিনিময়ে নেওয়া হয় ১৭ হাজার রিয়াল বা ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। আলী আকবরের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের দোভাষী পাড়ায়। সৌদি প্রবাসী এই আকবরের মাধ্যমে অভিবাসী রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউনুচ। পাসপোর্ট করিয়ে দেয়ার নামে আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত পেতে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন করেন তিনি। গত ২১ মে করা এই আবেদনপত্রের অনুলিপি পুলিশ সুপার ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ১৪টি দপ্তর প্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছে। । এ বিষয়ে তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়,সৌদি আরবে থাকাকালীন সময়ে ব্যক্তিগত পাসপোর্টের কাজে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে যান ইউনুচ। সেখানে নোয়াখালীর কামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির পরিচয় হয় তার। পরে কামালের মাধ্যমে সাতকানিয়া উপজেলার মামুন ও আনোয়ারা উপজেলার আলী আকবরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা তিনজনই বাংলাদেশী আয়ের স্বপ্ন দেখান তারা। এক পর্যায়ে ইউনুচও আকবরের সঙ্গে এ কাজে ছড়িয়ে পড়েন। আলী আকবরের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অভিবাসী রোহিঙ্গাদের কয়েকশ পাসপোর্ট বানিয়েছেন ইউনুচ। তবে কাজ চলমান অবস্থায় একটা দুইটা বানিয়েছেন করে ৯১টি পাসপোর্ট আটকা এ পড়ে দূতাবাসে। ওই ৯১টি পাসপোর্ট বানাতে আলী আকবরকে দেওয়া হরেছিল ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। কিন্তু পাসপোর্টগুলো আটকে পড়ার অজুহাতে এসব টাকা আর ফেরতা দিচ্ছেন না আলী আকবর। জাল জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র এবং ভূয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন আলী আকবর। কিন্তু একাই এই অসাধ্য সাধন করেননি তিনি। এ কাজে আলী আকবরের সঙ্গে জড়িত তার তিন সহোদরসহ বড় এক চক্র। এভাবে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়ে কয়েক বছরের ব্যবধানে আলী আকবর বনে যান কোটিপতি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বেশ কয়েকটি দোকান দোকান এবং নিজ এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি কিনেছেন। এমন কি আলী আকবর ও তার ছোটভাই রুহুল আমিনের ব্যবহৃত পাসপোর্টও জাল বলে উল্লেখ করা হয় আবেদনপত্রে। আলী আকবরের ছবি সম্বলিত পাসপোর্টটি জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে ইস্যু করা হয় ২০২১ সালের ২২ জুন।ওই পার্সপোর্টধারীর নাম-ইব্রাহিম, পিতা-নুরুজ্জামান, মাতা-রহিমা বেগম, ঠিকানা-বটতলী, ৩ নম্বর ওয়ার্ড, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। পাসপোর্টে ব্যবহৃত জন্মনিবন্ধন (১৯৬৮১৫৯০৬০১০২৫৬৩৫) অনুযায়ী তার, জন্ম তারিখ-১ জানুয়ারি ১৯৬৮। জন্য নিবন্ধনটি ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশদের ১ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে করা হয়। কিন্তু আলী আকবরের জাতীয় পরিচয়পত্রে (৫০৬৯৬৯৩৮১৯) উল্লেখিত তথ্যে দেখা যায়, নাম- মো. আলী আকবর, পিতা-মো আইয়ুব আলী, মাতা-মোছাম্মৎ রহিমা বেগম, ঠিকানা-দোভাষী পাড়া, ইউনিয়ন- বটতলী,ওয়ার্ড নং-১, উপজেলা-আনোয়ার, চট্টগ্রাম। এনআইডিতে তার ও জন্ম তারিখ ৫ অক্টোবর ১৯৮১। তার ব্যবহত পাসপোর্ট ও এনআইডি নাম-ঠিকানার গলমিলের পাশাপাশি বয়সের ব্যবধান ১৩ বছর। এছাড়া আলী আকবরের ভাই রুহুল আমিনের পাসপোর্ট থাকা জন্মনিন্ধন নম্বরের ১৯৯৫১৫১০৪৫৭০০৩৭৭৯) কোনো অস্তিত্ব নেই তত্য বাতায়নে। তার পাসপোটর্টে পিতা- মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, মাতা-সাফিয়া বেগম, ঠিকানা- বটতলী, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম উল্লেখ রয়েছে। পাসপোর্টি জেদ্দার বালাদেশ কনস্যুলেট থেকে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি ইস্যু করা হয়। কিন্তু রুহুল আমিনের আসল জন্মনিবন্ধনে (১৯৯৫১৫১০৪৫৭১১৫৩৭০) পিতা-আইয়ুুব আলী, মাতা-রহিমা বেগম, ঠিকানা-বটতলী, ১ নম্বর ওয়ার্ড, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম দেখা যায়। উপজেলা নির্বচন অফিসের তথ্যভান্ডারে তার এনআইডি নম্বর খুঁজেও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বটতলী গ্রামে গিয়ে পাসপোর্টধারীর ছবি দেখালে সৌদি প্রবাসী আলী আকবর ও রুহুল আমিনকে চিনেছেন সবাই। তবে আলী আকবরের পাসপোর্টে দেওয়া নাম ইব্রাহিমকে চিনতে পারেননি কেউ। তাদের পাসপোর্টে থাকা পিতা-মাতার নামও সঠিক নয় বলে জানান এলাকাবাসী। তাদের দুই পাসপোর্টে জরুরি যোগাযোগের ব্যক্তির নাম রয়েছে হাফেজ আহমদুর রহমান। সম্পর্কে তিনি তাদের ভগ্নিপতি পাসপোর্ট জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে হাফেজ আহমদুর। রহমান জানান, ‘রুহুল আমিনকে আমি চিনি তবে ইব্রাহিমকে চিনি না। তাদের পাসপোর্টে নাম-ঠিকানার গরমিলের বিষয়ে আমি এ কিছু জানি না।’ এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তাজ বিল্লাহ বলেন, ‘পাসপোর্ট দুটি দেখে জানতে পেরেছি এগুলো সৌদি আরবের জেদ্দা কনস্যুলেট থেকে করা হয়েছে। এর বেশি আমি কিছুই বলতে পারছি না। বিস্তারিত জানতে চাইলে জেদ্দা কনস্যুলেটে যোগাযোগ করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলী আকবর ২০১২ সালে হজ¦ পালন করতে গিয়ে। দেশে না-ফিরে থেকে যান সৌদি আরবে। সেখানে জেদ্দায় প্রবাসী ছোটভাইয়ের আশ্রয়ে থাকেন বেশ কিছু দিন। এরমধ্যে নিজের জন্য, বাংলাদেশি অন্যজনের পাসপোর্ট কিনতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন দালাল চক্রে। সৌদি আরবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় যাওয়া প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে।
মিয়ানমারের বাসিন্দা হলেও নাগরিকত্ব না থাকায় এসব রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড়ের চেষ্টায় থাকেন। সেখানে যাওয়া বাংলাদেশিদের মূলত টার্গেট করেন রোহিঙ্গারা। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিচয় হয়। তাদেরই কেউ কেউ দেশে লোক ধরে এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন। এর বাইরে একটি দালালচক্রও রয়েছে। আলী আকবরের দ্বারা এমন ঘটনারই শিকার হয়েছেন ইউনুচ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড দোভাসী পাড়ার বাসিন্দা মৃত আইয়ুব আলীর চার ছেলে চার মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে আলী আকবর ও রুহুল আমিন সৌদি আরবের জেদ্দা প্রবাসী। আর মামুন উদ্দিন ও আরমান উদ্দিন গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তারমধ্যে আয়মান উদ্দিন ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত বলে জানা যায়। ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরমানকে ইয়াবাসহ আটক করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় আরমানকে প্রধান আসামি করে দুইজনের বিরুদ্ধে সিএমপির কোতোয়ালী থানায় মামলা করা হয়। যার মামলা নং-জিআর ৩২২/১৮। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে বটতলী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) মো.জানে আলম বলেন,’এ গ্রামে আলী আকবর ও রুহুল আমিন নামে দুই ভাই সৌদি আরবে থাকেন। পুলিশের কোনো অফিসার ওই নামের কারও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে কোনো সময় আমার সাথে কথা বলেনি। তবে তাদের পরিবারের বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশ আমাকে ফোন দেয়।’
পাসপোর্ট জালিয়াতি ও অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে আলী আকবরের ভাই মামুন উদ্দিন বলেন, যে ব্যক্তি অভিযোগটি করেছেন। তাকে আমরা চিনি না। তাকে খুঁজেও পাইনি অভিযোগটি ষড়যন্ত্রমূলক করা হয়েছে। তবে তার দুই ভাইয়ের পাসপোর্টে ভূয়া নাম-ঠিকানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে তার ভাই আরমান উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করলেও কল কেটে দেওয়ায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) মো সোহানুর রহমান সোহাগ বলেন, বিষয়টি বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার দিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে কিছু দিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। আশা করছি, তদন্ত কাজ শেষে এ সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেলন জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদন পরবর্তী আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।